শুক্রবার, ১ আগস্ট, ২০১৪

"সন্তু লারমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘাত বন্ধ হবে না"- জেএসএস-এর সাধারণ কর্মীবৃন্দ

সিএইচটি নিউজ বাংলা, ১ আগস্ট ২০১৪, শুক্রবার

গত ৩ জুলাই ২০১৪ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস মদদপুষ্ট বোরখা পার্টির পাঁচ সদস্য ইন্দ্র মাস্টার, মুলুক্যা, লন্ধুপেদা, চমোক্যা, আহম্মদ গণি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে দল ত্যাগ করে লক্ষীছড়িতে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর তারা বোরখা পার্টির আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল অবস্থা, কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ও অসন্তোষ, আর্মি ও প্রশাসনের সাথে তাদের সম্পর্ক, সন্তু গ্রুপের কমান্ডারদের বেপরোয়া দুর্নীতি, চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ইত্যাদি বিষয়ে খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করেন। নিচে তাদের বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তুলে ধরা হলো:


বিশেষত অনিল ও সাবেক কয়েকজন শান্তি বাহিনীর সদস্যের খপ্পড়ে পড়ে এবং সামাজিক বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে আমরা বোরখা বাহিনীতে যোগদান করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বোরখা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি উদীয়মান নতুন রাজনৈতিক দল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি বোরখা, জেএসএস এবং আর্মি সবাই একই গর্তের শিয়াল। তাদের তিন সংস্থার ঘনিষ্টতা দেখেই বুঝা যায় যে এরা এক মায়ের পেটের সন্তান। এরকম একটা নাড়ির সম্পর্ক না থাকলে লক্ষীছড়ি সেনা জোন থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরত্বে জুর্গাছড়ির মত স্থানে সশস্ত্র অবস্থায় দিনের পর দিন দিব্যি আরামে অবস্থান করতে পারার কথা নয়।

আমাদেরকে বলা হয়েছিল লক্ষীছড়ি, মানেকছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা এসব এলাকা থেকে ইউপিডিএফকে উচ্ছেদ করতে হবে। এই কাজে আমরা আর্মিদের কাছ থেকেও শতভাগ সাহায্য সহযোগিতা পাবো। বর্মাছড়ি ও লক্ষীছড়ি এলাকা আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে আসলে টাকা পয়সারও আর কোন অভাব হবে না। আমাদের স্থানীয় এলাকা আমরাই নিয়ন্ত্রন করবো। ইউপিডিএফ এর লোকজন বাহির থেকে আসা। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসবে কেন? সেই বহিরাগতদের নীতিবাক্য আমরা শুনতেও চাই না। তাই অস্ত্র ধারণ করেই তাদেরকে উখাত করে আমাদের স্থানীয়দের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে হামলা-মামলার কোন আশঙ্কা নেই। সেই ব্যাপারে আর্মি ও সিভিল প্রশাসনের সাথে গোপন বুঝাপড়া রয়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি, অনিলের কারণে লক্ষীছড়ির অবস্থা আজ এরকম হ-য-ব-র-ল। অনিল না হলে বোরখা-টোরখা কিছুই সৃষ্টি হতো না। সে ইউপিডিএফ এর সাথে যে বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। তার ন্যায্য পাওনা সে কড়ায়-গন্ডায় পেয়েছে। সেভাবে না মরলে তার জীবনের পাওনা কিছু বাকী থাকতো। তার জন্য আমাদের কোন আফসোস হয় না।

জেএসএস বাহিরে লোক দেখানো প্রচারণা চালায় যে, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তারা আন্দোলন করছে। কিন্তু আমরা এতদিন যাব বোরখা বা জেএসএস এর কাজ করে থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনদিন কোন আলোচনাই হয় নি। জেএসএস নেতৃবৃন্দরা সে বিষয়ে আমাদেরকে টু শব্দটিও শুনান নি।

কমান্ডার জঙ্গী একটা বড় শক্তি নিয়ে এখানে আসলেও তাদের কমান্ডারদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং জেএসএস এর প্রতি স্থানীয় লোকজনের আন্তরিক সমর্থন না থাকায় ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে কোন কাজ করা সম্ভব হয় নি। কলিন্স ও জঙ্গীর মধ্যে রেষারেষি এমন ছিল যে তারা একে অপরকে মোটেই সহ্য করতে পারেন না। শুধুমাত্র জঙ্গী এবং কলিন্সের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে এমন নয়। সকল কমান্ডারদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা, অমিল এসব খুবই প্রকট। তাদের বেহাল অবস্থা দেখে আমরা হতাশ।

বোরখারা প্রায় ৪০ টি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে লক্ষীছড়ি এলাকায় প্রবেশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সফল হয় নি। খিরাম-নানুপুর এলাকার বাঙালিদের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়া এবং নিজেদের মধ্যে রেষারেষির কারণেই এই লজ্জাজনক অবস্থা।

লক্ষীছড়ি ও মানেকছড়ি এলাকার সশস্ত্র গ্রুপটি পরিচালনার জন্য মাসিক যত টাকা প্রয়োজন সবই রাঙ্গামাটি থেকে পাঠানো হয়। ঐ টাকাটা কলিন্সের হাতে থাকে অর্ধেক আর জঙ্গীর হাতে থাকে অর্ধেক। সেখান থেকে কর্মিদের পিছনে ব্যয় হয় মাত্র সিকি অংশ। বাকী টাকা চলে যায় তাদের দুই জনের পকেটে। মূল দায়িত্বে চার্মিং বাবু থাকলেও তিনি মাঠে খুব কমই আসেন। থাকেন রাঙামাটিতে। চার্মিং বাবু আর কলিন্স বাবু সম্পর্কে ভায়রা, চাকমা ভাষায় “লবয়-সজন”। দু’জনের মধ্যে গোপন বুঝাপড়া। তাদের কয়েকজনের সমন্বয়ে একটা গোপন সিন্ডিকেটও রয়েছে। লোকজন অপহরণ করে ও বিভিন্ন পেশাজীবীর কাছ থেকে স্থানীয়ভাবে যে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করা হয় সেগুলি কোথাও জমা দেয়া হয় না। ঐ গোপন সিন্ডিকেটটি সব টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। এক্ষেত্রে ভাগ্য ফুলে যায় সংশ্লিষ্ট কমান্ডার ও কালেক্টর বাবুদের। কলিন্স বাবু প্রায়ই বিকাশের মাধ্যমে তার বাড়িতে ও চার্মিং বাবুকে মোটা অংকের টাকা পাঠিয়ে থাকেন। এনিয়ে কর্মিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে।

গত দুই বসর আগে কলিন্স বাবুর বাড়িতে বসার জন্য একটি চেয়ার বা চৌকি পর্যন্ত ছিল না। অন্য এক জনের এককক্ষ বিশিষ্ট একটি আধচালা ঘরে ছিল তার বসবাস। সেখানেই রান্না-বান্না, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া এবং সেখানেই ঘুমাতে হতো। কিন্তু লক্ষীছড়িতে দায়িত্বে আসার পর দুই বছরের ব্যবধানে তিনি এখন রাঙামাটির বুকে জায়গার মালিক হয়েছেন, ছিমছাম বাড়ি বানিয়েছেন, হাই-ফাই ফ্যামিলির কর্তা হয়েছেন! আর কি চায়! যাদুর কাঠি তার নিজের হাতে। এই ধরনের লোকেরা কোন দুঃখে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের অবসান চাইবেন ??

জেএসএস সংস্কারপন্থী নেতাদের সাথে কলিন্স বাবুর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ট ব্যক্তিও নাকি সেদিকে কাজ করছে। এখানকার গোপন বিষয়গুলি তিনি প্রতিনিয়ত মোবাইলে সংস্কারদেরকে জানিয়ে থাকেন। তাই তার ভূমিকা নিয়ে অধিকাংশ কর্মিদের মনে সন্দেহ রয়েছে। 

জঙ্গীর ভাষ্য হচ্ছে- “আমি অনেক পুরনো সদস্য হলেও এতদিন পার্টির আসল কাজ বুঝি নি। এবার বুঝেছি। আর ভুল করব না।” [অর্থা আগে তিনি পার্টির নিয়ম মেনে কাজ করে ‘ভুল’ করেছেন, এবার তিনি সে ভুল করবেন না।] তিনি এবার বিল্ডিং নির্মাণ আরম্ভ করেছেন। এই হচ্ছে তার ভুল ভাঙা। বর্মাছড়ির দেব রঞ্জন এখন শুধু টাকার ধান্ধায়। মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ছলে বলে কলা-কৌশলে টাকা আদায় করাই এখন তার প্রধান কাজ।

জেএসএস এর মধ্যে এখন হতাশা ও বিশৃঙ্খলা চরমে। অনেকের ভাষ্যমতে তারা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতকে আরো ১০ বসর স্থায়ী করতে চান। কারণ তাদের ছেলে-মেয়েরা বর্তমানে স্কুল কলেজে পড়া-লেখা করছে। নিজের কোন চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যও নাই। তাদের এমন কোন আয়ের উস নেই যা দিয়ে তারা ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার খরচ মিটাতে পারে। এমতাবস্থায় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত জিইয়ে থাকলে সব সময় একটা মোটা অংকের ইনকাম সোর্স খোলা থাকে। আর তা হচ্ছে- মুক্তিপণ আদায়, চাঁদার নামে ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা কালেকশন, পার্টি থেকে নিয়মিত মাসিক ভাতা ইত্যাদি। আর এতে করে নিজেদের সংসারও চলে ভাল। তাই তাদের মতে ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থে এই সংঘাত আরো ন্যুন্যতম ১০ বসর স্থায়ী হওয়া দরকার।

চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের বিষয়ে সেখানেও সাধারণ কর্মি মহলে বিভিন্নভাবে আলোচনা পর্যালোচনা হয়। অধিকাংশ কর্মির মতামত হচ্ছে- এভাবে ‘ফেলাফেলি’ [হানাহানি] করে কোনদিন সমস্যার সমাধান হবে না। একটা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। তবে সন্তু লারমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত এই সংঘাত বন্ধ হবে না। তার একগুঁয়েমি ও উগ্র মনোভাব এই মারামারিকে জিইয়ে রেখেছে। তার কট্টর ও উগ্রতার খেসারত দিতে হচ্ছে সবাইকে। দুইজন আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য, চার-পাঁচজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডার এবং অধিকাংশ সাধারণ কর্মির মুখ থেকেও এ একই কথা উচ্চারিত হতে আমরা দুই কানে শুনেছি (নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের নাম উল্লেখ করা হল না)। 

লক্ষীছড়ির বিষয়টি সন্তু লারমা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। সেখান থেকে লোকজন দেখা করতে এসেছে এমন খবর তার কাছে পৌঁছার সাথে সাথে তিনি তার অফিস থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে শুধুমাত্র লক্ষীছড়ির লোকদের সাথে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বসেন। ইউপিডিএফকে কিভাবে শায়েস্তা করা হবে, কোন কাজটা কীভাবে করতে হবে, এলাকাটি যত দ্রুত সম্ভব দখলে নেওয়া কেন এত জরুরী ইত্যাদি বিষয়ে তিনি নিজেই ব্রিফ করে থাকেন।
-------------