বুধবার, ২৫ মে, ২০১১

মুরুং "উপজাতি" সেনাবাহিনীর কেমন বন্ধু?

উইনী মারমা

লামা-আলীকদম উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত মুরুং হেডম্যান ও কার্বারীদের নিয়ে মঙ্গলবার আলী কদম সেনা জোন সদরে এক মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জোন কমান্ডার লে. কর্ণেল এসএম ইমরানউজ্জামান বলেন, পাহাড়ি এলাকায় মুরুং 'উপজাতি' সেনাবাহিনীর অকৃত্রিম বন্ধু (দেখুন: আলীকদমে মতবিনিময় সভা: পাহাড়ি এলাকায় মুরুং উপজাতি সেনাবাহিনীর অকৃত্রিম বন্ধু, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৫ মে ২০১১) এই অকৃত্রিম বন্ধত্বের নিদর্শনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আশির দশকে মুরুং বাহিনী গঠিত হয়ে সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে পার্বত্য এলাকা থেকে সন্ত্রাস নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে"

বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে ও তাতে সতত পুষ্টি দিয়ে ওই জাতিগুলোর ওপর শাসন শোষণ জারি রাখা হলো শাসকগোষ্ঠীর বহু পুরানো কৌশল বৃটিশরা এই উপমহাদেশে দু্ই শত বছর ধরে এই কৌশল প্রয়োগ করে তাদের শাসন টিকিয়ে রেখেছিল ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের আগে ফ্যাসিস্ট জার সরকার সে দেশে এক জাতির বিরুদ্ধে আরেক জাতিকে উস্কে দিতো এবং তাদের মধ্যে সব সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতো রাশিয়াকে লেনিন জাতিসমূহের কারাগার বলে অভিহিত করেছিলেন এবং তার নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব সফল হওয়ার পরই কেবল ওই নিপীড়িত জাতিগুলো মুক্তি লাভ করেছিল

বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত বাঁধিয়ে দিতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক ১৯৮০ দশকে সেনাবাহিনী মুরুং জাতির জনগণের পশ্চাদপদতার সুযোগ নিয়ে শান্তিবাহিনীর আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল অবশ্য সে সময় শান্তিবাহিনীরও মারাত্মক ভুল হয়েছিল মুরুংদের সাথে কোন কারণে তাদের বিরোধ দেখা দিলে তারা মুরুং গ্রামে হামলা চালিয়ে গণহত্যা সংঘটিত করেছিলসেনাবাহিনী তখন শান্তিবাহিনীর এই ভুলের পূর্ণ সুযোগ নেয় ইমরানউজ্জামান সাহেব এজন্যই মুরুংদের 'অকৃত্রিম বন্ধু' বলে প্রশংসা করছেন অবশ্য তিনি বন্ধুত্বের আসল নিদর্শনের উল্লেখ করেননি তিনি বাঙালি জনগণের পক্ষে মুরুংদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলতে পারতেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুরুং জাতির জনগণ তত্‍কালীন মেজর ও পরর্তীতেতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আশ্রয় দিয়েছিলেন

যাই হোক, এই 'অকৃত্রিম বন্ধুত্বের' প্রতিদান হিসেবে মুরুংদের কি প্রতিদান দেয়া হয়েছে? পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগুলোর মধ্যে মুরুংরাই এখনো পর্যন্ত শিক্ষা দীক্ষায় ও অর্থনৈতিক মানদণ্ডে সবচেয়ে পেছনে পড়ে রয়েছেন অথচ এই অবস্থা থেকে তাদেরকে তুলে আনার জন্য সরকারের কোন উদ্যোগ দেখা যায় না শুধু তাই নয়, গত জরুরী অবস্থার সময় বিনা ক্ষতিপূরণে তাদের জমি কেড়ে নিয়ে তথাকথিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, নানা কৌশলে তাদের জুম চাষের এলাকা সীমিত করে দেয়া হয়েছে এবং আলীকদমসহ বিভিন্ন জায়গায় এখনো তাদের জমি বেদখল করা হচ্ছে সম্প্রতি বান্দরবানের রুমা এলাকার জনগণ, বিশেষত মুরুংরা, সেনাবাহিনী কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে লংমার্চ করেছেন ১৯৭০ দশক থেকে সেনাবাহিনী রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের জন্য তাদের তিনটি মৌজার ৯,৫৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে এই অধিগ্রহণ প্রচেষ্টা সফল হলে হাজার হাজার মুরুং পরিবার তাদের বংশপরম্পরায় বাস করে আসা জমি থেকে চিরতরে উত্‍খাত হবে এবং এতে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে পড়বে এই ধরনের অন্যায় ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী মুরুং নেতা রাংলাই ম্রোকে গ্রেফতার করে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল ও তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অস্ত্র মামলা দিয়ে জেলে দীর্ঘদিন আটক রেখেছিল " অকৃত্রিম বন্ধুত্বের" প্রতিদান হিসেবে মুরুংরা নিশ্চয়ই এ ধরনের বর্বর নির্যাতন ও শোষণ আশা করেনি

সরকারের উচিত সবচেয়ে পশ্চাদপদ জাতি হিসেবে মুরুং ও খুমী জাতির ব্যাপারে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাঙামাটিতে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হচ্ছে তাতে এই মুরুং জাতির কি উপকার হবে? ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য একজন মুরুংও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ রয়েছে কাজেই সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে প্রাইমারী ও হাইস্কুল লেভেলের ভিত্তি শক্তিশালী করা বিশেষত মুরুংদের শিক্ষর দিকে নজর দেয়া আর "অকৃত্রিম বন্ধুত্বের" সবচেয়ে ভালো প্রতিদান হবে রুমাসহ বিভিন্ন এলাকায় মুরুংদের জমি বেদখল বন্ধ করা, রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল করাকারণ রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম এমনিতেই একটা ক্যান্টনমেন্ট হয়ে আছে সেনানিবাসের নামে জমি অধিগ্রহণের আসল উদ্দেশ্য আসলে মুরুংদের নিজ ভূমি থেকে উত্‍খাত করা কারণ সেনানিবাস সমপ্রসারণের উছিলা ছাড়া আর অন্য কোন কারণ দেখিয়ে সেখানে মুরুংদের জমি কেড়ে নেয়ার সুযোগ নেই আমরা চাই, মুরুংদের সাথে বন্ধুত্বের ভাব দেখিয়ে তাদেরকে গলা টিপে ধরা বন্ধ হোক

---- সমাপ্ত ----