সিএইচটি নিউজ বাংলা, ১২ এপ্রিল ২০১৩, শুক্রবার
নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্যে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী সামজিক উৎসব বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু (বৈসাবি) শুরু হয়েছে আজ।
ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা
ভাষায় সাংগ্রাই এবং চাকমা ভাষায় বিঝু এই তিন সম্প্রদায়ের প্রথম আধ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি শব্দটি এখন প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এছাড়া তঞ্চঙ্গ্যারা উৎসবকে বিষু এবং অহমিয়া সম্প্রদায় বিহু নামে পালন করে
থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অপরাপর সম্প্রদায়ও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে।
তিনদিন ব্যাপী এ উৎসবের
আজ ১২ এপ্রিল প্রথম দিন চাকমাদের ফুল বিঝু
। এ উপলক্ষে সকালে খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদীতে ভাসানো হয়েছে ফুল। এছাড়াও ফুল দিয়ে সাজানো
হয়েছে ঘরবাড়ি।
বৈসুঃ ত্রিপুরারা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে বৈসুমা বা বৈসুকমা, তার আগের দিনটিকে হারি বৈসু এবং নববর্ষ প্রথম দিনটিকে বিসিকাতাল বলে। হারি বৈসুর দিন তারা বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়, গরু, মহিষ, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুদের খুব ভোরে ঘর থেকে ছেড়ে দেয়। ছেলে-মেয়েরা নতুন কাপড় পড়ে এই ঘর থেকে ঐ ঘরে ঘুরে বেড়াই। ত্রিপুরারা তাদের বৈসুমা দিনে তাদের বাড়িতে অতিথিদের মদ, পিঠা, পাচন দিয়ে আপায়ন করে ঐ দিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা নুনছড়ি দেবতা পুকুর বা নদী থেকে জল এনে তাদের নানা-নানী, দাদা-দাদীসহ স্থানীয় গুরুজনের স্নান করে তাদের কাছে আর্শীবাদ গ্রহণ করে। বৈসু সময় ত্রিপুরারা গরাইয়া নাচে শিল্পিরা পাহাড়ী পল্লীঘরে ঐতির্য্যবাহী নিত্য পরিবেশন করে।
সাংগ্রাই:মারমারা সাংগ্রাইয়ের
১ম দিনকে পেইংছুয়ে (১৩ এপ্রিল)-২য় দিনকে আক্যেই মুল সাংগ্রাই (১৪ এপ্রিল) ৩য় দিনকে
(১৫ এপ্রিল) আতাদা ও ৪র্থ দিনকে আপ্যেইং (১৬ এপ্রিল) হিসেবে পালন করে পুরানো বছরকে
মুছে ফেলে নতুন বছর গ্রহণের ঐতিহ্যবাহী মৈত্রী পানীয় উৎসব বা
জলকেলী উৎসবের
মাধ্যমে তারা যুবক-যুবতীদের একে অপরকে বর্ষ বরণ ও বিদায় পবিত্র বৃষ্টিতে সিক্ত করে।
এই ছাড়াও পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ
নেয়। অনেক এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধ মূর্তি গুলোকে গোসল করানো হয়। সারাদিন প্রস্তুতি
চলে পরবর্তী দিন বা উৎসবের মূল দিনের খানাপিনা আয়োজন। উৎসবের
২য় দিনে প্রত্যেকের বাড়ীতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে ৩০-৩৭ বা তার
বেশী আনাসপাতি দিয়ে তৈরী পাচন, পানীয় পরিবেশন করা হয়। সাংগ্রাই প্রধান উৎসবে কেন্দ্রস্থল
মন্দির বা ক্যায়াং ঘরে প্রথম দিনে ভালভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় মেতে উঠে। দায়ক-দায়িকারা
টানা তিনদিন অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় দীক্ষায় অভিভূত হয়ে বুদ্ধ মূর্তির সামনে ফুল রেখে
ও মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করে। পাড়ার লোকজন ক্যায়াং ঘরে গুরু ভিক্ষু, শ্রমণ, সাধু-সাধুমাদের
উদ্দেশ্যে ছোয়াইং প্রদান করে। চন্দনের পানি, দুধ ও ডাবের পানি দিয়ে বুদ্ধ মূর্তিকে
স্নান করানোর মধ্য দিয়ে সূচনা হয় সাংগ্রাইং এর নতুন বছর । ঐ দিন তরুণ-তরুণীরা জলবর্তী
পাত্র দিয়ে দলে দলে এসে সাংগ্রাইতে মিলেমিশে জলকেলি বা পানি খেলাতে মেতে উঠে।
বিঝু: চাকমারা ১ম
দিনে ফুল বিজু, ২য় দিনকে মুল বিজু ও ৩য় দিনকে গোজ্জেপোজ্জে বিঝু হিসেবে পালন করে থাকে।
উৎসবের
প্রথম দিনে ঘরবাড়ী ও আঙ্গিনা পরিস্কার করা ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এই দিন পাহাড়ী
ছড়া, ঝর্ণা বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে মা গঙ্গাকে পূজা করে গোসল করা হয়। এ ছাড়াও
পাড়ার যুবক যুবতীরা নদী থেকে পানি তুলে প্রবীণদের গোসল করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। অনেক
এলাকায় দল বেঁধে বুদ্ধ মূর্তি গুলোকে গোসল করানো হয়। এরপর সারাদিন প্রস্তুতি চলে
পরবর্তী দিন বা উৎসবের
মূল দিনের খানাপিনা আয়োজন। উৎসবের ২য় দিনে প্রত্যেকের বাড়ীতে নানা মূখরোচক খাবারের আয়োজন
করা হয়। এতে ৩০-৩৭ বা তার বেশী আনাসপাতি দিয়ে তৈরী পাচন এবং মদ পানীয় পরিবেশন করা
হয়। নানা বয়সী লোকজন সারাদিন দল বেঁধে হৈ-হুল্লা (আনন্দ) আওয়াজ করে ঘুরে বেড়ায়।
৩য় দিনে দল বেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরে
সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়। এই দিন অনেকে
পাড়ার বয়স্ক মুরব্বীদের বাড়ীতে ডেকে ভাল কিছু খাবার দেন। আর অনেকের উৎসবের
তিনদিন মন্দির, বাড়ীর আঙ্গীনা, নদীর ঘাট, সবুজ গাছের নীচে এবং গোয়াল ঘরে বিভিন্ন
দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালান।
বৈসাবি উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলো নিজেদের কৃষ্টি,সংস্কৃতি ধারণ
করে ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। কাজের ব্যস্ততার আড়ালে সুখ দুঃখ, গ্লানি
এই দেশের মাটি উর্বর হোক, ফুলে ফলে ভরে উঠুক শস্য ক্ষেত, পরিমিত বৃষ্টি জল-হাওয়া বর্ষিত
হোক, প্রবাহিত হোক এই দেশের মাটিতে বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠি ও প্রাণীকূল সমান অধিকারে
বেঁচে থাকুক এই প্রার্থনার মধ্য দিয়েই বৈসাবি উৎসব
পালন করা হয়।
-----