[পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওর রিজভীর ‘বর্তমান সরকারের মেয়াদেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।’ এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক অনলাইন সংবাদ মাধ্যম সিএইচটি২৪ ডটকম একটি মন্তব্য প্রকাশ করে। পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে এই মন্তব্যটি হুবহু এখানে প্রকাশ করা হলো—সম্পাদক]দৈনিক প্রথম আলোতে (১০মে, ২০১৩) প্রকাশিত রিপোর্ট মতে আমরা জানতে পারলাম রাজধানীর একটি হোটেলে গত বৃহস্পতিবার ইন্ডিজেনাস পিপলস বিষয়ক সংসদীয় ককাস আয়োজিত পার্বত্য চুক্তি নিয়ে নীতিগত পরামর্শ প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে গওহর রিজভী বলেছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। তিনি বলেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি, এটা নিয়ে হতাশা আছে।
এছাড়া তিনি আরো বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো নয়। চুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ক্রমশ কমে আসবে।
গওহর রিজভী ভূমি সমস্যাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি আরো বলেন, চুক্তি-পরবর্তী ১৫ বছরে পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে মন্তব্য করে তিনি চুক্তি বাস্তবায়নে পাহাড়ি নেতৃত্বকে আরও ‘বাস্তববাদী’ হওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রথমে গওহর রিজভীকে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন যে তিনি স্বীকার করেছেন যে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি। তবে বর্তমান সরকারের মেয়াদেই পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের আশ্বাস আমাদের কাছে ফাঁকা বুলি বলেই মনে হচ্ছে! এই বুলি কপচিয়ে কী হবে তা আদৌ এখন বোঝা যাচ্ছে না!
এরপরে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁকে সানন্দিত ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হিসেবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সেনা কর্তৃত্ব বা সেনাশাসন বিদ্যমান তা এক অর্থে বা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়ার জন্য। এই কথাটি অনেক প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ব্যক্তি-ব্যক্তিত্ব মুখেই তুলে আনেন না। সেদিক থেকে গওহর রিজভী একবাক্যের মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ক্রমশ কমে আসবে’ কথাটি বলে অত্যন্ত অকপটতার পরিচয়ই দিয়েছেন বলা যায়।
কিন্তু ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো নয়’ এই বক্তব্যটি তিনি কোন প্রেক্ষাপটে বলেছেন তা বোধগম্য হচ্ছে না! দেশের অন্য অনেক এলাকার তুলনায় পার্বত্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো নয়’ ?! এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বরং আমরা জানি পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের অন্য অনেক এলাকার চেয়ে অনেক ভালো। অন্য এলাকায় যে হারে চুরি-চামারি-ডাকাতি-ছিনতাই-ধর্ষ
এখানে মনে রাখা দরকার যে, পার্বত্য সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপই নিতে হবে। এবং এই রাজনৈতিক পদক্ষেপ মানে হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জাতিসত্তাসমূহের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা। আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই এই রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি সংঘাত বিরাজ করছে। জারি রয়েছে ‘ভাগ কর-শাসন কর নীতি’। এই ভাগ করে শাসন করার নীতির অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান দুই পার্টির মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখার একটি ‘ম্যাকানিজম’ এই অঞ্চলে সদা বিদ্যমান। এই সত্যটিই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির ক্ষেত্রে সবথেকে বড় সত্য!
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী সেই সত্যটি স্বীকার না করে ‘রাজনৈতিক কারণে’ আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে বিবেচনা করে পার্বত্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভালো নয়’ বলে মতামত দিয়েছেন।
কেন তিনি এই মত দিয়েছেন? বাংলা ভাষায় একটি কথা প্রচলিত রয়েছে- সাপ হয়ে দংশন করা, ওঝা হয়ে ঝাড়া। দেশের সকল সময়ের সরকারই এই রুল ফলো করে পার্বত্য পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে রেখেছে।
সুতরাং, গওহর রিজভীর এই মন্তব্য যতই সাদামাটা মনে হোক না কেন, তার একটি
রাজনৈতিক রূপ রয়েছে। আর সেই রূপ বা উদ্দেশ্য টি হচ্ছে, ‘সাপ হয়ে দংশন করা ওঝা হয়ে
ঝাড়া’।
এই বিষয়টিকে বিবেচনা করে গওহর রিজভীর সকল মন্তব্য পর্যালোচনা করে দেখলে আমরা এই সিদ্ধান্তেই আসবো যে, এই সরকারের মেয়াদে ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন’ ঘোষনা “ফাঁকা বুলি” হয়েই থেকে যাবে। এবং ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির’ উন্নতির লক্ষণ দেখা যাবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে কম থাকবে। অর্থাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসন তথা ‘সেনাবাহিনী ভূমিকা’ কমবেশি চলমানই থেকে যাবার সম্ভাবনা শতকরা শতে শত ভাগই হবে!
আমরা এই মন্তব্য কলামে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং অন্য এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তুলনামূলক পর্যালোচনা করলাম না। যদি করে থাকি তবে বোধকরি পার্বত্য চট্টগ্রামের চেয়ে অন্য এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে’ খারাপ বলেই স্বীকার করতে হতে পারে। এতে দেশের অন্য এলাকাতেও ‘সেনাবাহিনীর ভূমিক’ রাখা প্রয়োজন এই অনুসিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনাই বেশি হতে পারে বলেই বোধ জাগে!
সূত্র: সিএইচটি২৪ ডট কম