রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
সিএইচটি নিউজ বাংলা,
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৩
গত ২৩ ফেব্রুয়ারী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাঙামাটি সফর করে গেলেন। তার এই সফর সম্পর্কে মূল্যায়ন ও
বিশ্লেষণ হওয়া স্বাভাবিক। তবে যারা আশা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন
সম্পর্কে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবেন, আশার বাণী শোনাবেন, তারা নিঃসন্দেহে
হতাশ হবেন। রাঙামাটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত সমাবেশে তিনি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি,
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, উন্নয়ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য দেন। এমনকি
১৯৭০ সালে তার প্রথম রাঙামাটি ভ্রমণেরও স্মৃতিচারণ করেন। কিন্তু তার 'মূল্যবান'
বক্তব্যে তিনি কোথাও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্পর্কে একটা কথাও বলেননি। অথচ
তিনিই গত ১৫ বছর ধরে তার এই অঙ্গীকারের কথা আমাদের শুনিয়ে আসছিলেন।
আসলে তার এই সফর
পাবলিক রিলেশনস এক্সারসাইজ ছাড়া আর কিছুই নয়। গত নির্বাচনে জনগণ শেখ হাসিনার
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। ফলে সব পার্বত্য
আসনেই (তিনটি) দলটি জয় লাভ করে। কিন্তু গত ৪ বছরেও নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ না
করায় ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাদের সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়। এই
হতাশার বহিঃপ্রকাশ প্রধানমন্ত্রীর ১৭ নভেম্বরের বান্দরবান সফরের সময়ও দেখা গেছে।
সেখানে পাহাড়িদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। সমাবেশকে বড় করতে সমতলের কয়েকটি
উপজেলা থেকে লোক নেয়া হয় বলে তখন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। ২৩ ফেব্রুয়ারীর রাঙামাটির
সমাবেশেও পাহাড়িদের উপস্থিতি ছিল কম। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সমাবেশের যে ফুটেজ
দেখানো হয় তাতে পাহাড়ি মুখ খুব কমই দেখা গেছে।
পার্বত্য জনগণের এই
হতাশা আগামী নির্বাচনে গভীর প্রভাব ফেলবে এতে কোন সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ নেতারাও
এ জন্য ভীষণ চিন্তিত। তারা জানেন পাহাড়ি ভোটাররা দলটির উপর অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ। তাই
তারা টাইটানিকের মতো ডুবে যাওয়া তাদের দলের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে এখন মরিয়া
হয়ে উঠেছে। এতদিন প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা অনেক আশার বাণী
শুনিয়েছেন, মিষ্টি মধুর কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় বান্দরবানের সফর
হাতে নেয়া হয়। সেটাও ফ্লপ হলে পর শেষ চেষ্টা হিসেবে রাঙামাটির শোডাউনের সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়। কিন্তু সেখানেও পাহাড়িদের উপস্থিতি নগন্য হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাদের
কপালের ভাঁজ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘুর্ণি
সফর তাকে মিজোরাম সীমান্তবর্তী সাজেক ও বান্দরবানের কেওক্রাডং পাহাড়েও নিয়ে যায়।
এই দুই স্থানে তিনি মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করেন। সফরে তিনি মোট ছয়টি ভিত্তি প্রস্তর
স্থাপনে সময় ব্যয় করেন। এগুলো হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল
কলেজ, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, আসামবস্তি ব্রাহ্মটিলা সংযোগ সেতু, কাচালং নদীর ওপর
মাইনিমুখ গাদাছড়া সংযোগ সেতু এবং পুরানপাড়া-ঝুলিক্যা পাহাড় সংযোগ সেতুর ভিত্তি
প্রস্তর। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী রাঙামাটি শহরে তার পিতা শেখ মুজিবর রহমানের ভাস্কর্য
ও বরকল থানা ভবন উদ্বোধন করেন।
তাহলে প্রধানমন্ত্রীর
সফর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রাপ্তি কী? ছয়টি ভিত্তি প্রস্তর ও সাজেকের
দু'টি পাংকু গ্রামের বাসিন্দাদের টেলিভিশন পাওয়া ছাড়া প্রাপ্তির ঘরে আর কিছু কি
আছে? উদ্বোধিত ভাস্কর্য ও থানা ভবন তো তার আগমণ ছাড়াই আমরা পেতাম, সুতরাং
প্রাপ্তির তালিকায় তা বাদ যাবে।
এখানে আরো কথা আছে:
কোন কিছু পাওয়া এক জিনিস আর প্রাপ্ত বস্তুটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বা কাজের তা অন্য
জিনিস। যেমন ধরা যাক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের
বিষয়টি। এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের
অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু এখনই নয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ ও এখানকার
পরিস্থিতি এখনও তার জন্য উপযুক্ত নয়। আমার জ্ঞান সীমিত, তবে উইকিপিডিয়ায় দেখা যায়,
ভুটানে ২০০৩ সালেই কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, যার নাম রয়েল
ইউনিভার্সিটি অব ভুটান। আর ভুটান ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সাইন্সেস (বিআইএমএস) নামে
একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয় ২০১১ সালে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজ্ঞান ও
প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হলে তার নিয়ন্ত্রণ স্থানীয়
জনগণের হাতে থাকবে না। সমতলের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার ছাত্র পড়তে আসবে, ফলে
ক্ষুদ্র রাঙামাটি শহরে লোকের ভীড় আরো বাড়বে। স্থানীয় পাহাড়ি জনগণের সংস্কৃতি ও
জীবন ধারায় অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব পড়বে। রাজনীতিও বাদ যাবে না। বাইরে থেকে আসা
হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ভোটার হবে এবং সংসদ নির্বাচনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ও
নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে। তাই সন্দেহ হয় পাহাড়িদেরকে রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে
প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে এই দুই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে
কিনা। রাঙামাটিতে পাহাড়ি ও বাঙালি ভোটারের ব্যবধান এখনো বেশ বড়। কিন্তু বাইরে থেকে
শিক্ষার্থী হিসেবে কয়েক হাজার লোক আসলে সহজেই এই ব্যালেন্স পাল্টে যাবে। কাজেই
দেখা যায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সরকারী
সিদ্ধান্ত্ম সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। উক্ত দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয় জন পাহাড়ি পড়ার
সুযোগ পাবে? এই দুই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে চাকমা-মারমা ভিন্ন ম্রোসহ
অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগুলোর শিক্ষা সম্পর্কে মায়াকান্না কম করা হয়নি। কিন্তু
প্রশ্ন হলো কতজন ম্রো - যাদের এসএসসি ও এইসএসসি পাস করা লোকের সংখ্যা এখনো হাতে
গোনা - ওই দুই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করবে? অন্যান্য
জাতিগুলো সম্পর্কেও একই প্রশ্ন প্রযোজ্য। যদি সত্যিই পার্বত্য চট্টগ্রামে
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন হয়, তাহলে তাতে ৫,০০০
ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পাহাড়ি হবে বড় জোর ১০০ জন।
কাজেই প্রধানমন্ত্রীর
রাঙামাটি সফর নতুন করে অনেকের চোখ খুলে দিয়েছে। সবাই আজ বুঝে গেছে, পার্বত্য
জনগণকে দেয়া তার অঙ্গীকার ছেলে ভুলানোর গল্প ছাড়া কিছুই নয়। এতদিন তিনি
পাহাড়ি-দরদীর মুখোশ পড়েছিলেন। তার কথায় সন্তু লারমাসহ অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে তার মুখোশ খুলে পড়েছে। তিনি মুখে বলেন একটা করেন আরেকটা। তিনি
একদিকে শান্তির কথা বলেন, অন্যদিকে তার সরকারের আমলে সাজেক, খাগড়াছড়ি, লংগুদু,
রামগড় ও রাঙামাটিতে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। তিনি একদিকে বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে
ভূমির মালিক হবেন পাহাড়িরা, অন্যদিকে ভূমি কমিশন নিয়ে করেন লুকোচুরি খেলা। তিনি এক
সময় 'আদিবাসী' বলে মুখে ফেনা তুলেছিলেন, কিন্তু সরকার গঠনের পর বললেন দেশে কোন
আদিবাসী নেই। তিনি পাহাড়িদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেন, অথচ পঞ্চদশ
সংশোধনীর মাধ্যমে পাহাড়িদেরকে বাঙালি জাতীয়তার মধ্যে বিলীন করে দেন।
এটা বললে অত্যুক্তি
হবে না যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা শেখ মুজিবর রহমানের পার্বত্য
চট্টগ্রাম সম্পর্কিত নীতিই বাস্ত্মবায়ন করে চলেছেন -- তবে কিছুটা ভিন্নভাবে। তিনি
তার পিতার মতো পাহাড়িদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন না বা পার্বত্য চট্টগ্রামে
লক্ষ লক্ষ বাঙালি ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দেন না, তিনি মিষ্টি কথা বলে পাহাড়িদের
প্রতারিত করেন ও একই নীতি বাস্ত্মবায়ন করেন। শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি
সফরের সময় তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোমাদের বাঙালিতে উন্নীত করা হলো’। শেখ
হাসিনা তার সফরের সময় সে রকম কিছু বলেননি, বরং উন্নয়নের ঘুম পাড়ানী গান শুনিয়ে
পাহাড়িদেরকে নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দিতে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
শেখ মুজিবর রহমানের সেটাই ছিল সরকার প্রধান হিসেবে প্রথম ও শেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম
সফর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে
পাহাড়িদের চাওয়ার বেশী নেই। তারা চায় তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক, যুগ যুগ ধরে
যে ভূমিতে তারা লালিত পালিত হয়ে এসেছেন সেই জমিতে তাদের পূর্ণ অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ
ফিরিয়ে দেয়া হোক। নিজেদের জাতীয় পরিচিতির স্বীকৃতি এবং নিজেদের সংস্কৃতি কৃষ্টি
জীবনপদ্ধতি নিয়ে বসবাস করার জন্য স্বায়ত্তশাসন দেয়া হোক। পাহাড়িদেরকে নিজ ভূমি
থেকে উৎখাত করতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও স্বৈরাচারী
এরশাদের শাসনামলে নিয়ে আসা সেটলারদেরকে সমতলে ফিরিয়ে নেয়া হোক। প্রধানমন্ত্রীর
উচিত যে অঙ্গীকার তিনি পাহাড়িদের দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করা।
নিজেদের ন্যায্য
অধিকার না পেলে কোন জাতি, সমাজের কোন শ্রেণী শান্ত হয় না। এমনকি শিশুরাও দুধ না
পেলে তাদের কান্না থামায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও তাদের অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত
সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাধ্য। [সমাপ্ত]