রাজনৈতিক ভাষ্যকার, সিএইচটি নিউজ বাংলা, ২৭ মে ২০১১
গত ২০ মে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়েছে, ইউপিডিএফ-এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে কিনা, সে বিষয়টি নিয়ে এখন সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে। স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার বিবিসিকে বলেছেন, পার্বত্য এলাকার পরিস্থিতির জন্য ইউপিডিএফ-এর তত্পরতাকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এই সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি এখন আলোচনায় এসেছে। বিবিসির উক্ত খবর মতে, সম্প্রতি খাগড়াছড়ির রামগড়ে সংঘটিত সহিংস হামলার প্রেক্ষাপটে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এক বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় ইউপিডিএফ বিষয়ে আলোচনা হয়।
স্বরাষ্ট্র সচিবের উপরোক্ত উক্তি থেকে বেশ স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ-কে নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র বেশ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্রুপের সভাপতি সন্তু লারমা প্রথম ইউপিডিএফ-কে নিষিদ্ধের দাবি তোলেন। ইউপিডিএফ-কে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি একদিকে ইউপিডিএফ-এর সাধারণ সদস্য ও সমর্থকদের ওপর একের পর এক সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছেন, অন্যদিকে নিষিদ্ধের দাবি তুলে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। গত ২০ মে স্বরাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য ও রাঙামাটিতে তাদের ছাত্রদের এক সমাবেশে সন্তু লারমা উক্ত নিষিদ্ধের দাবি পুনর্ব্যক্ত করার পরদিনই তার লেলিয়ে দেয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা রাঙামাটির সুবলঙের মিদিঙাছড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে কেন্দ্রীয় নেতা অনিমেষ চাকমাসহ নিরস্ত্র নিরপরাধ চার ইউপিডিএফ সদস্যকে হত্যা করে। সেনাবাহিনীও দীর্ঘদিন ধরে ইউপিডিএফ-কে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিত্রিত করতে চাইছে। গতকাল, ২৬ মে, সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর এক বিবৃতিতে ইউপিডিএফ-কে "পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় সৃষ্টিকারী একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল" আখ্যায়িত করে ২৩ মে সড়ক অবরোধের দিন পারভেজ আলম নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার সাথে ইউপিডিএফ-কে জড়িয়ে মনগড়া অভিযোগ উত্থাপন করেছে। স্বরাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য, সেনাবাহিনীর ভাষ্য ও সন্তু লারমার দাবি একসাথে মিলিয়ে দেখলে তাদের মধ্যে ইউপিডিএফ-বিরোধী গোপন আঁতাত সম্পর্কে সহজেই আঁচ করা যায়।
কিন্তু কেন ইউপিডিএফ এর বিরুদ্ধে তাদের এই "পবিত্র ঐক্য"? কেন সরকার ইউপিডিএফ-এর সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন? কারণ একটাই -- সেটা হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে একমাত্র ইউপিডিএফ-ই জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। জেএসএস-এর আত্মসমর্পনের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে নতুন করে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ও সেনাবাহিনীর ভয় হলো এই গণআন্দোলন। আর এই আন্দোলন ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়েই তারা ইউপিডিএফ-কে নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্র করছে। অপরদিকে, নিষিদ্ধ করার অজুহাত সৃষ্টির জন্য সরকার তার বশংবদ সন্তু লারমাকে ব্যবহার করে তার মুখ দিয়ে ইউপিডিএফ নিষিদ্ধের দাবি তুলছে।
কিন্তু সরকার কোন যুক্তিতে ও অজুহাতে ইউপিডিএফ-কে নিষিদ্ধ করবে? ইউপিডিএফ তার গঠনতন্ত্রের ২ নং ধারায় স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছে যে, "পার্টির লক্ষ্য হইল শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের ন্যায্য অধিকার পূর্ণস্বায়ত্তশাসন অর্জনের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলে শোষণ-নিপীড়নমুক্ত প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।" ইউপিডিএফ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রীতি নীতি সাংগঠনিক তত্পরতা চালিয়ে আসছে। পার্টি এ যাবত যে ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে তা দেশের অন্যান্য দলগুলোর মতোই। প্রসিত খীসা নিউ এজ-কে দেয়া সাক্ষাতকারে যথার্থই বলেছেন ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি প্রশ্ন করেন, যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নেয়া হয় যে ইউপিডিএফ-এর দু'একজন সদস্য কোন অপরাধের সাথে যুক্ত তাহলে কি তার জন্য পুরো পার্টিকে নিষিদ্ধ করা যায়? এক্ষেত্রে সরকার ইউপিডিএফ-এর ওই সদস্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে, কিন্তু পুরো একটি দলের গণতান্ত্রিক সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে না।
সেনাবাহিনী বলছে ইউপিডিএফ "পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অন্তরায় সৃষ্টিকারী"৷ তাদের এই অভিযোগ সর্বাংশে মিথ্যা৷ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে অন্তরায় সৃষ্টিকারী হলো সরকার ও সেনাবাহিনী নিজেরাই, এমনকি সন্তু লারমাও অনেকাংশে দায়ী। ইউপিডিএফ চুক্তির দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে সমালোচনা করলেও, চুক্তি বাস্তবায়নের পথে কোন দিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শুধু তাই নয়, ইউপিডিএফ বহু আগে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকার ও জেএসএস-কে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যেখানে সরকার যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধের বদলে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ দিচ্ছে, যেখানে চরম দক্ষিণপন্থী ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী দলের সাথে রাজনৈতিক মোলাকাত করছে, যেখানে গণতন্ত্রের দুশমন স্বৈরাচারী এরশাদের সাথে জোট বেঁধেছে, সেখানে ইউপিডিএফ-এর মতো একটি গণতান্ত্রিক দলকে নিষিদ্ধ করা হবে আইন ও সংবিধান বিরুদ্ধ, ফ্যাসিস্ট ও চরম অন্যায়? সরকার যদি ইউপিডিএফ-কে নিষিদ্ধ করে তাহলে তা করতে হবে গায়ের জোরে, আইনের জোরে নয়। আর যদি সত্যি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে তা সমস্যা সমাধানের বদলে পরিস্থিতিকে আরো বেশী জটিল করবে।এতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
--- সমাপ্ত ---