সিএইচটি নিউজ বাংলা, ১৯ মে ২০১৩, রবিবার
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে তামাক
আগ্রাসনে বিপন্ন হতে চলেছে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার
ফসলি জমিতে অবাধে চলছে তামাক চাষ। আর এতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারের তামাক বিরোধী
অভিযান। অপরদিকে এর ক্ষতিকর প্রভাব ও ব্যবহৃত কীটনাশকের ফলে উর্বরতা
হারাচ্ছে ফসলি জমি।
দেশী-বিদেশী ট্যোবাকো কোম্পানির লোভনীয় অফারে
আকৃষ্ট হয়ে পাহাড়ের সাধারণ কৃষকরা ক্ষতির চিন্তা ভুলে গিয়ে সাময়িক মুনাফার
আশায় ফসলি জমিগুলোতে তামাক চাষে লিজ দিতে ঝুঁকে পড়ছে অতিমাত্রায়। এ জেলার মোট
৮টি উপজেলায় অর্ধলক্ষাধিক একর ফসলি জমিতে এবছর করা হয়েছে তামাক চাষ। ট্যোবাকো
কোম্পানিগুলো তামাক চাষীদের মাঝে দাদনের অর্থ ও সার সরবরাহসহ তামাক চাষের সকল
প্রয়োজনীয় উপকরণাদী সরবরাহ করে চলেছে। সার, কীটনাশকসহ প্রয়োজনীয় পুঁজির
নিশ্চয়তায় প্রলুব্ধ হয়ে স্থানীয় সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালি কৃষকরা বুঝে না বুঝে উৎসুক তামাক চাষে।
স্থানীয় কৃষকরা অন্য ফসল থেকে লিজ দিয়ে তামাক
চাষ করে অধিক মুনাফা পাওয়ায় তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ও জমির উর্বরা শক্তি নষ্টের
সম্ভাবনা জেনেও ট্যোবাকো কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিয়েছে তাদের হাজার হাজার একর
ফসলি জমি। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি, দিঘীনালা, মহালছড়ি, রামগড়,
মানিকছড়ি ও সদর উপজেলাসহ জেলার সবকটি উপজেলার বেশীরভাগ ফসলি জমিগুলোতে তামাক
চাষের চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে।
এদিকে তামাক চাষ প্রসঙ্গে কৃষি বিভাগ সঠিক কোন
তথ্য বা পরিসংখ্যান দিতে না পারলেও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়,
এ বছর জেলার আটটি উপজেলায় প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক একর ফসলি জমিতে তামাক চাষ করা
হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী জেলার দিঘীনালা উপজেলায়।
তামাক চাষীদের সাথে আলাপ হলে জানা যায়,
সুবিধাভোগী একশ্রেণীর মহাজন ও প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ীর পাশাপাশি অনেক ট্যোবাকো
কোম্পানি পার্বত্য এলাকার সহজ সরল ও অজ্ঞ চাষীদের বোকা বানিয়ে সহজ শর্তে
সরবরাহকৃত ঋণ এবং কীটনাশকের নামে সুকৌশলে চড়া সুদ আদায় করে নিচ্ছে। এছাড়াও
সময়মতো ট্যোবাকো কোম্পানিগুলোর চাহিদা মাফিক তামাক সরবরাহ করতে না পারলে বা কোন
কারণে ফসল ভালো না হলে দাদনের টাকা দ্বিগুন হিসাব করে পুনরায় পরবর্তী বছরের জন্য
দাদন প্রদান করছে। এতে করে কৃষকের কষ্টার্জিত অর্থ বৃটিশ নীল করদের কায়দায়
ট্যোবাকো কোম্পানি, দাদন ব্যবসায়ী ও মহাজনদের হাতে চলে যাচ্ছে। যা পার্বত্য
এলাকার এসব সহজ সরল বোকা চাষীরা বুঝতেই পারছেন না।
তামাক চাষী হিরণ চাকমা ও শহিদুল ইসলাম মিয়া’র
সাথে কথা হলে অন্যান্য ফসলের তুলনায় অধিক লাভ ও তামাক কোম্পানি থেকে অগ্রীম
নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার কথা উল্ল্যেখ করে তারা বলেন, এক একর জমিতে অন্য ফসল আবাদ
করলে যেখানে ১৫-২০ হাজার টাকার ফসল উৎপাদিত হয় সেখানে তামাক
চাষের মাধ্যমে ৫০-৬০ হাজার টাকার তামাক উৎপাদন করা যায়।
আবার কয়েকজন কৃষক জমির উর্বরতা শক্তি ও পরিবেশের
ক্ষতির কথা ভেবে তামাক চাষ করা ঠিক নয় উল্ল্যেখ করে তামাক চাষের কারণ হিসেবে তারা
ঋণ বা অন্যান্য সবজির দাম কমসহ অন্যান্য ফসলের অনিশ্চিত বিক্রয় মূল্য এবং
হিমাগারের অভাবকে দায়ী করেন। তাদের অভিযোগ এই এলাকা থেকে নির্বাচিত সাংসদরা
বরাবরই নির্বাচিত হলে জেলার প্রতিটি উপজেলায় একটি করে হিমাগার স্থাপনের
প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসলেও প্রতিটি উপজেলায়তো দূরের কথা আজ অবধি পুরো জেলায়ও একটি
হিমাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়নি কোন সাংসদই। হিমাগারের অভাবে কৃষকরা অন্য ফসল চাষে
আগ্রহ হারিয়েছে বলেও অভিযোগ পাহাড়ের খেটে খাওয়া কৃষকদের।
পাহাড়ে তামাক চাষের ব্যাপকতা দিন দিন বাড়লেও
সরকারের তামাক বিরোধী অভিযান আজ পর্যন্ত এ অঞ্চলে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
যার ফলে বৃটিশ নীল করদের কায়দায় ট্যোবাকো কোম্পানিগুলো এ অঞ্চলে ঘাঁটি বেঁধে
বসেছে। পার্বত্য এলাকার পরিবেশ সুরক্ষায় তামাক আগ্রাসন বন্ধ হওয়া জরুরী বলে মনে
করেন পরিবেশ প্রেমীরা। তাদের দাবী, তামাক চাষের কারণে পরিবেশের পাশাপাশি তামাক
চুল্লিতে কাঠ পোঁড়ানোর কারণে সরকারি রিজার্ভ ফরেষ্টগুলো বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়ছে।
এছাড়া তামাক চুল্লিতে তা পক্রিয়াজাত করণের ফলে কৃষকের যে স্থাস্থ্য হানি ঘটছে
তাও আমলে নেই এসব অজ্ঞ কৃষকদের।
পার্বত্য এলাকার পরিবেশ অচিরেই তামাক চাষ বন্ধ
জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের নেই কোন সু-দৃষ্টি। সরকারের
তামাক বিরোধী অভিযান স্বার্থক ও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিপন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ
রক্ষায় এখনই প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ।