সিএইচটি নিউজ বাংলা, ৮
এপ্রিল ২০১৩, সোমবার
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বড়নাল ইউনিয়নের প্রাণ কুমার পাড়ায় উপর্যুপরি সেটলার হামলার পর ভয়ে ২৭টি পাহাড়ি পরিবার ঘর ছাড়া হয়ে পড়েছে। তারা বর্তমানে বামা গোমতির অপুর্ণ মহাজন পাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার বড়নাল ইউনিয়নের প্রাণ কুমার পাড়ায় উপর্যুপরি সেটলার হামলার পর ভয়ে ২৭টি পাহাড়ি পরিবার ঘর ছাড়া হয়ে পড়েছে। তারা বর্তমানে বামা গোমতির অপুর্ণ মহাজন পাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
ভুক্তভোগীদের সাথে কথা
বলে জানা যায়, গত ২ এপ্রিল সেটলাররা প্রাণ কুমার পাড়ায় প্রথম হামলা চালায়। সেদিন রাত
আনুমানিক ২টার সময় ৪০/৫০ জন সেটলার দুর্জয় ত্রিপুরার বাড়ি ঘেরাও করে ইউপিডিএফ সদস্যদের
দেখেছো কিনা জিজ্ঞাসা করে। সে দেখেনি বলে উত্তর দিলে সেটলাররা তাকে মারধর করে। এ সময়
সেটলাররা পল্টনজয় ত্রিপুরার (৪২) বাড়ির দরজাও ভেঙে দেয়। সেটলারদের হামলার সময় তাদের
পিছনে বিজিবি'র পোশাক পরা লোকজন ছিল।
এই হামলার পর গত ৫ এপ্রিল
সেটলাররা দ্বিতীয় বার প্রাণ কুমার পাড়ায় হামলা চালায়। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ধন
বিকাশ ত্রিপুরা (৩৭) পিতা: জবিন্দ্র ত্রিপুরা বলেন, ‘রাত আনুমানিক ১:৩০টার সময় আমতলী
ও বড়নাল ইউনিয়নের চৌদ্দগ্রাম পাড়া, শরৎ মাষ্টার পাড়া, জাফর পাড়া, করিম মাষ্টার পাড়া থেকে
২/৩ হাজার সেটলার চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। এরপর সেটলাররা পরিকল্পিতভাবে একজন
বাঙালির বাড়ির টিনের চালের উপর কিছু ঢিল ছুঁড়ে মারে এবং পটকাবাজি ফুটিয়ে সন্ত্রাসী
এসেছে বলে চিৎকার দিয়ে আমার বাড়িতে হামলা চালায় এবং আমাকে বেদম
মারধর করে। আমি মাথায় আঘাত পেয়ে মাটিতে পড়ে গেলে আমার মা, স্ত্রী ও আমার ভাইয়েরা আমাকে
রক্ষা করতে ছুঁটে আসলে সেটলাররা তাদেরকেও বেদম মারধর করে। সেটলাররা আমার বাড়ি, দোকান,
টেলিভিশন ও সাইকেলসহ সকল জিনিসপত্র ভেঙে চুরমার করে দেয় এবং দোকানের জিনিসপত্র ও মোবাইল
লুট করে নিয়ে যায়।’
যারা সেটলারদের মারধরের
শিকার হয়েছেন তারা হলেন দুর্জয় ত্রিপুরা (২২), কান্ত্মারায় ত্রিপুরা (৩০), চান্দে রায়
ত্রিপুরা (২২), কাম্ভারায় ত্রিপুরা (২০), তপন বিকাশ ত্রিপুরা (২৫), জ্যোতিরায় ত্রিপুরা
(২১), বোবা রায় ত্রিপুরা (১৮) কিশোর রায় ত্রিপুরা (২৮), শোভা রঞ্জন ত্রিপুরা (২৪)।
এর মধ্যে তপন বিকাশ ত্রিপুরা পায়ে ও কানে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। তিনি এখন কানে শুনতে
পাচ্ছেন না।
সেটলারদের হামলার ভয়ে ঘরছাড়া
হওয়ার কারণে জাবারাং কল্যাণ সমিতি কর্র্তৃক নির্মিত প্রাণকুমার কার্বারী পাড়া বেসরকারী
প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ফলে ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে।
এছাড়া এ এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সেটলারদের হামলার ভয়ে পরীক্ষা দিতে পারছে না।
হামলাকারী সেটলারদের মধ্যে
আওয়ামী লীগের নেতা হাশেম, কালাম মিয়া, মনিরা, জাকির, মোমিন, করিম চিনতে পেরেছেন বলে
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। তারা জানান, বড়নাল ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রফিক মেম্বার,
মীর কাসেম, মোমিন, আমতলী ইউনিয়নের শামসু মেম্বার, ইউনুস মেম্বারের নেতৃত্বে সেটলাররা
এ হামলা চালিয়েছে।
ঘটনার পর গতকাল ৭ এপ্রিল
বিজিবি সদস্যদের সামনে মালেক নামে এক সেটলার বাঙালি (বিএনপির সাথে জড়িত) হুমকি দেয়
যে, এলাকা ছেড়ে চলে না গেলে সবাইকে জবাই করা হবে। ফলে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা এখন খুবই
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গ্রামে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না।
তপন বিকাশ ত্রিপুরা ঘটনার
বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি দোকান থেকে বাড়িতে আসার পর হাত-পা ধুয়ে ভাত খাওয়ার পর ঘুমিয়ে
পড়ি। রাত আনুমানিক ১টা থেকে ১.৩০টার মধ্যে চিলস্নাচিলিস্নর শব্দ শুনে আমার স্ত্রী-সন্ত্মানদের
জাগিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। এ সময় দেখি সেটলাররা আমার বড় ভাই ধন বিকাশ ত্রিপুরাকে মারধর
করছে। আমি এসে তাদেরকে বলি ভাইকে মারধর করবেন না। আপনারা কি করছেন। আপনারা একটু শান্ত
হোন। কিন্তু তারা কোন কথা শুনতে চায়নি। এ সময় আমার পরিচিত জাহাঙ্গীর, মনির, মীর কাশেম,
নুরুমিয়া, হাশেম, আবুল হোসেন হুমকি দিয়ে বলে ত্রিপুরা বংশদের একটাও রাখবো না, সাফ কেটে
ফেলবো। একেবারে শেষ করে ফেলবো। এ সময় আমি ভাইকে রক্ষা করতে চাইলে তারা আমাকে কানের
উপর চড় মারে। এতে আমি প্রচণ্ড আঘাত পাই। এখনো কানে শুনতে পাই না। এরপর তারা আমাকে লাঠিসোটা
দিয়ে মারধর করে। এতে পায়েও আঘাত পাই। তাদের উপর্যুপুরি আঘাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এসময়
সেটলাররা আমার মোবাইল, হাতঘড়ি লুট করে নিয়ে যায়। হাসেম, মনির, আবুল হোসেন আমাকের মারধর
করেছে।’
যেসব পরিবার বর্তমানে পালিয়ে
বেড়াচ্ছে তারা হলেন, ১. ধন বিকাশ ত্রিপুরা, ২. পল্টনজয় ত্রিপুরা, ৩. তোকলাই মনি ত্রিপুরা,
৪. রত্নাদেবী ত্রিপুরা (বিধবা মহিলা), ৫. জবিন্দ্র ত্রিপুরা, ৬. তৈমালা ত্রিপুরা, ৭.
চাক্কেলা ত্রিপুরা, ৮. কান্তা রায় ত্রিপুরা, ৯. শোভা রঞ্জন ত্রিপুরা, ১০. লতাবি ত্রিপুরা,
১১. চান্দে রায় ত্রিপুরা, ১২. দুর্জয় ত্রিপুরা, ১৩. জ্যোতিরায় ত্রিপুরা, ১৪. বিনন্ত
ত্রিপুরা, ১৫. একআনা ত্রিপুরা, ১৬. দুইআনা ত্রিপুরা (গ্রামের কার্বারী), ১৭. তপন বিকাশ
ত্রিপুরা, ১৮. রতন ভূষণ ত্রিপুরা, ১৯. কাম্ভারায় ত্রিপুরা, ২০. কিশোর রায় ত্রিপুরা,
২১. ধন মোহন ত্রিপুরা, ২২. বারন কুমার ত্রিপুরা, ২৩. শিয়ালছা ত্রিপুরা, ২৪. জীবন কুমার
ত্রিপুরা, ২৫. জহরলাল ত্রিপুরা, ২৬. ভগ্ন কুমার ত্রিপুরা, ২৭. সিদ্ধিজয় ত্রিপুরা।
ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক
ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক রিকো চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের
সভাপতি নতুন কুমার চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমেন চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের
সভানেত্রী কণিকা দেওয়ান এক যুক্ত বিবৃতিতে মাটিরাঙ্গায় বিনা উস্কানিতে উক্ত সেটলার
হামলার তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্ত্মি দাবি করেছেন।
নেতৃবৃন্দ বলেন পাহাড়ি
গ্রামবাসীদের উৎখাত করে তাদের জমি ও বাস্তুভিটা কেড়ে নেয়ার জন্যই
এই বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়েছে।
-------