রাজনৈতিক
ভাষ্য, সিএইচটি নিউজ বাংলা, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, সোমবার
অবশেষে গত ২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক হামলা
চালানো হলো। রাঙামাটি কলেজে দুই ছাত্রের মধ্যে কথা কাটাকাটির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে
ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে সাধারণ নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ
কোন সভ্য মানুষ করতে পারে না। যারা ওই হামলা চালিয়েছে তাদেরকে বর্বর ও সভ্য সমাজের
কলংক ছাড়া আর অন্য কিছু দিয়ে আখ্যায়িত করা যায় না।
প্রথম আলো আজ সম্পাদকীয় কলামে লিখেছে, ‘আদিবাসী
এক ছাত্রের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে রাঙামাটি কলেজের বাঙালি ছাত্রটি বহিরাগতদের
সঙ্গে নিয়ে কলেজে হামলা চালালে ছাত্ররা জাতিগত ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে যায়। তবে
কলেজের ঘটনাটিকে সংঘর্ষ বলা গেলেও কলেজের বাইরে যা ঘটেছে তা সোজাসাপ্টা
জাতিবিদ্বেষী হামলা’।
পত্রিকাটি আরো লিখেছে: ‘ঘটনার
বিবরণ বলছে, বিষয়টি আদিবাসী বনাম বাঙালিদের সংঘর্ষ নয়, বরং একতরফা বাঙালিদের তরফে
আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনাই সেখানে ঘটেছে। পুলিশ এ ঘটনায় একজনকেও গ্রেপ্তার করতে
পারল না বা কারও বিরুদ্ধে মামলাও হলো না?’
বস্তুত, বেশ কয়েকদিন ধরে উগ্রসাম্প্রদায়িক
গোষ্ঠীটি পাবর্ত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর হামলা চালানোর অজুহাত
ও সুযোগ খুঁজছিল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির বেতছড়িতে সেটলাররা পাহাড়িদের ১৫ একর
জমি বেদখলের চেষ্টা চালালে তা গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ করে। খাগড়াছড়ি প্রশাসন দ্রুত
পদক্ষেপ নেয়ার কারণে গোষ্ঠীটি দাঙ্গা বাধাতে পারেনি।
তবে সেটলাররা পরদিন ‘পাহাড়িদের
হামলার’ প্রতিবাদে
খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে এবং বাজারে আসা দুই পাহাড়িকে বিনা কারণে
মারধর করে। এ ক্ষেত্রেও পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কারণে (আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে
দেয় ও হামলাকারী কয়েকজনকে আটক করে) এবং পাহাড়িরা সেটলারদের এসব উস্কানির
ফাঁদে পা না দেয়ায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায় নি। উক্ত হামলার প্রতিবাদে ইউপিডিএফ
এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে, 'দৃশ্যতঃ সেটলারদের একটি বিশেষ অংশ পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য অজুহাত সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। গতকাল রবিবার বেতছড়িতে ভূমি বেদখল প্রচেষ্টা ও আজ সোমবার ভূয়া ইস্যু নিয়ে খাগড়াছড়ি শহরে তাদের মিছিল তারই ইঙ্গিত বহন করে।'
এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর আবু তাহের নামে পানছড়ির এক নেতার ওপর
পাহাড়িরা হামলা করেছে এই অভিযোগে পানছড়িতে উগ্রসাম্প্রদায়িক
গোষ্ঠীটি উত্তেজনা ছড়ায়। উক্ত নেতার ওপর হামলার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়। অনেকের
ধারণা খাগড়াছড়ি
থেকে মোটর সাইকেল যোগে পানছড়ি যাওয়ার সময় তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তবে যেই
হোক, উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটি বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়।
তারা পানছড়িতে
পরদিন হরতাল
আহ্বান করে ও এক পাহাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানকে মারধর করে। শুধু তাই নয়, তারা
খাগড়াছড়িতেও জঙ্গী মিছিল বের করে। আহত হয়েছেন আওয়ামী লীগের এক নেতা, আর বিক্ষোভ
মিছিল ও হরতাল পালন করছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ। পানছড়িতে হরতালের সাথে
আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট নয় বলেও পানছড়ির আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান যা পত্রিকায়
প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় স্পষ্ট বোঝা যায় উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীটি কি চাইছে।
খাগড়াছড়িতে দাঙ্গা বাঁধাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের টার্গেট হয়
রাঙামাটি। সাবেক
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের মরদেহ পাকিস্তান থেকে রাঙামাটিতে নিয়ে আসার বিরুদ্ধে
তারা অবস্থান নিয়ে বিরাট ইস্যু সৃষ্টি করে ও প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়। সড়ক অবরোধও
পালন করে। অথচ সমঅধিকার আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য
চট্টগ্রামে অন্যান্য উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে
রাজাকার গোলাম আজমসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে কখনো সোচ্চার হতে
দেখা যায়নি। বরং তাদের রাজনীতি এই রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের সাথেই গাঁটছড়াভাবে
যুক্ত। তাই বড় প্রশ্ন থেকে যায়, এটা যদি ত্রিদিব রায়ের মরদেহ না হয়ে গোলাম আজমের কিংবা
সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মরদেহ হতো তাহলে তারা এভাবে প্রতিহত করার ঘোষণা দিতেন
কীনা।
২২ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে যে হামলা হলো তা তথাকথিত
সমঅধিকারওয়ালাদের ত্রিদিব রায়কে নিয়ে আসা প্রতিহত করার কর্মসূচীর অংশ মাত্র। তাছাড়া
রাঙামাটি কলেজে এক পাহাড়ি ও এক বাঙালি ছাত্রের মধ্যে কথা কাটাকাটিও পরিকল্পিত
ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। অর্থাৎ
যে
কোনভাবে পাহাড়িদেরকে মারামারিতে প্ররোচিত করা, যাতে সেটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার
করে পাহাড়িদের ওপর আক্রমণ করা যায়। আমরা আশাকরি, রাঙামাটি কলেজে গঠিত তদন্ত কমিটি
এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখবে।
আগ্রাসী বাঙালীদের হামলা রোধে রাঙামাটি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও
প্রশ্ন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আশে পাশে বাঙালিদেরকে লাঠি হাতে ঘোরাফেরা করতে
দেখা গেছে। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর কাছাকাছি অবস্থান থেকেই তারা পাহাড়িদের
বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। এ সময় উপস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর
সদস্যদেরকে সম্পূর্ণ নীরব থাকতে দেখা গেছে। আড়াই ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালানোর পরই কেবল
দুপুর একটার দিকে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এই দীর্ঘ সময়ে পুলিশ ও অন্যান্য আইন
শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুই করেনি। তারা বরং বাঙালিদেরকে হামলার সুযোগ করে দিয়েছে।
আক্রমণকারীদের মধ্যে একজনকেও গ্রেপ্তার না করায় হামলায় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ না
হলেও পরোক্ষ ইন্ধন ছিল কিনা যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়।
রাঙামাটির পরিস্থিতি এখনো থমথমে। সর্বত্র ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ
করছে। এটা দূর করা প্রশাসন তথা সরকারের দায়িত্ব। যদি আগের মতো হামলাকারীদের বিচার
ও শাস্তি না হয়, যদি উগ্রসাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষটির গোড়ায় অশুভ শক্তি সার পানি ঢালা
অব্যাহত রাখে এবং যদি প্রশাসন তার নিরপেক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়,
তাহলে ধরে নিতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো ২২ সেপ্টেম্বরের মতো ঘটনা অপেক্ষা
করছে। গত সাড়ে তিন দশকের অভিজ্ঞতা এই উপসংহারে আসতে আমাদের বাধ্য করে।
অপরদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকেও এবং বিশেষত পাহাড়িদেরও
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে
মোকাবিলা করা ছাড়া অন্য কোন পথ জনগণের সামনে খোলা নেই। দুই পার্টির মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি
সহিংসতায় আজ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০০ জন নিহত হয়েছেন (এর মধ্যে ইউপিডিএফের ২৫০ জনের
কাছাকাছি)। তারা যদি ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে প্রাণ দিতে বাধ্য না হয়ে অধিকারের
লড়াইয়ে শহীদ হতেন তাহলে কে জানে আজ হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ের বুকে
স্বায়ত্তশাসনের সূর্যের উদয় হতো। [সমাপ্ত]